, মঙ্গলবার, ২৮ অক্টোবর ২০২৫, ১৩ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
শিরোনাম :
ময়মনসিংহে যুবদলের ৪৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বর্ণাঢ্য র‍্যালি ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত চৌদ্দগ্রামে ইউএনও’র সাথে সাংবাদিক সমিতির মতবিনিময় অনুষ্ঠিত চৌদ্দগ্রামে ব্যবসায়ীর বাড়িতে ডাকাতির সময় জনতার হাতে আটক ৩ গণপিটুনি দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করলো স্থানীয়রা এদেশে আর কাউকে ফ্যাসিবাদ কায়েম করতে দেওয়া হবে না চৌদ্দগ্রামে শ্রীপুর ইউনিয়ন জাতীয়তাবাদী যুবদলের কর্মী সভা অনুষ্ঠিত সাংবাদিকতায় সকল বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের মানুষিকতা থাকতে হবে প্রশিক্ষণ কর্মশালায়-শিবলী সাদিক খান ভোটাধিকার ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাই ৩১ দফার মূল লক্ষ্য — বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হাজী ইয়াছিন চৌদ্দগ্রামে তুলাপুষ্কুরণী সমাজ কল্যাণ ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে এসএসসি ও দাখিল পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের সংবর্ধনা প্রদান “আমরা শহীদ জিয়াউর রহমানের সৈনিক, আমাদেরকে ভয় দেখিয়ে লাভ নেই”- কামরুল হুদা কুমিল্লা সীমান্তে ০৫ কোটি ৭০ লক্ষ ৭১ হাজার টাকা মূল্যের ভারতীয় অবৈধ পণ্য জব্দ

দুর্নীতির আতুড়ঘর চৌদ্দগ্রাম এলজিইডি অফিস

 

 

চৌদ্দগ্রামে খাল খননের নামে পুকুর চুরির অভিযোগ উপজেলা এলজিইডি প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে

ঘুস, কমিশন বানিজ্য, ভুয়া ভাউচারে বিল উত্তোলন সহ রয়েছে বিস্তর অভিযোগ

 

কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে উপজেলা নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নুরুজ্জামানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন টেন্ডারে স্বজনপ্রীতি, ঘুস ও কমিশন বানিজ্যের মাধ্যমে খালের মাটি বিক্রি, খালপাড়ে গাছ লাগানোর নামে ভুয়া ভাউচারে অন্তত ৮ লাখ টাকা আত্মসাত সহ ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি তার বিরুদ্ধে সরকারি প্রকল্পের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এর চেয়ারম্যান বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। অভিযোগে বলা হয়, খাল উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ধনুসাড়া মিজির ব্রিজ থেকে সিংরাইশ ব্রিজ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের কানাইল খাল পুনঃখননের জন্য ২ কোটি ৪৯ লাখ ৮১ হাজার ১০১ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। ২০২৪ সালের ২ আগস্ট টেন্ডারের মাধ্যমে কাজটি সম্পন্নের দায়িত্ব পায় দাউদকান্দির হাসানপুরের ‘মেসার্স লিবার্টি ট্রেডার্স’ নামীয় ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। কার্যাদেশ অনুযায়ী খালের পাড় বাঁধাইকরণ শেষে খাল থেকে উত্তোলনকৃত অতিরিক্ত মাটিগুলো উম্মুক্ত টেন্ডারের মাধ্যমে বিক্রির কথা থাকলেও অভিযোগ উঠেছে উপজেলা প্রকৌশলী নুরুজ্জামানের প্রত্যক্ষ যোগসাজসে স্থানীয় একটি মাটি চক্রের মাধ্যমে রাতের আঁধারে ট্রাক্টর প্রতি ২০০ টাকা হারে অতিরিক্ত সব মাটি বিক্রি করে দেওয়া হয়। কোনো কোনো স্থানে খালের পাড় না বেঁধেই সকল মাটি বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। এতে সরকারি সম্পদ লুট ও অর্থ লোপাট, পরিবেশের মারাত্মক দূষণ হয়। রাতের আঁধারে চক্রটি মাটি পরিবহনকালে এলাকাবাসীর রাতের ঘুম নষ্ট হওয়া ও ফসলী জমিন নষ্টের প্রতিবাদে বিভিন্ন সময় মাটি ব্যবসায়ীদের সাথে খাল পাড়ের জমির মালিক ও স্থানীয়দের বাগবিতন্ডার ঘটনাও ঘটেছে। পরে প্রশাসনের হস্তক্ষেপে এ সকল সমস্যা নিরসনের আশ^াস পেয়ে স্থানীয় বিক্ষুব্ধরা কিছুটা শান্ত হয়। শেষ পর্যন্ত ফলপ্রসু কোনো সমাধান না হওয়ায় স্থানীয়রা বিষয়টি নিয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে যায়। এ বিষয়ে সুরাহার জন্য ইউএনও সহকারী কমিশনার (ভ‚মি) কে দায়িত্ব দেন। পরে স্থানীয়দের দাবির প্রেক্ষিতে এবং অনিয়ম পরিলক্ষিত হওয়ায় চৌদ্দগ্রাম উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভ‚মি) পূর্বের কার্যাদেশটি বাতিল করেন। এরপর ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান খনন কাজ অসম্পূর্ণ রেখে চলে যায়। কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে তাদের সাথে বারবার যোগাযোগ করা হলেও তারা এ ব্যাপারে কোনো সাড়া দেয়নি বলে প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে। এদিকে ঠিকাদারের অনুপস্থিতিতে যে সকল স্থানে খালটি পূণঃখনন করা হয়েছে সেসকল স্থান থেকে উত্তোলনকৃত পরিত্যক্ত মাটিগুলো উপজেলা প্রকৌশল অফিসের যোগসাজসে স্থানীয় মাটি খেকোদের মাধ্যমে সরিয়ে মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে অবৈধভাবে বিক্রি করা হয়। এভাবেই খাল খননের নামে চলে পুকুর চুরি ও সরকারি অর্থের হরিলুট। চলতি বছরের ২৫ মার্চ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভ‚মি) কর্তৃক কার্যাদেশটি বাতিল করা হলেও কাজ সম্পন্ন দেখিয়ে ঠিকাদারকে চ‚ড়ান্ত বিল হিসেবে ২ কোটি ৩৯ লাখ ২৫ হাজার ১৫৬ টাকা পরিশোধের জন্য গত ১৯ জুন নির্বাহী প্রকৌশলী কুমিল্লা বরাবরে চিঠি প্রেরণ করেন উপজেলা প্রকৌশলী নুরুজ্জামান। এরপর সে আলোকে বিল উত্তোলন করা হয় বলেও জানা গেছে। উপজেলা প্রকৌশলীর এ দ্বৈত আচরণে জনমনে নানান প্রশ্নের সৃষ্টি দিয়েছে। এদিকে খালপাড় বাঁধার পর সেখানে বিভিন্ন জাতের বিপুল পরিমান (২-৩ হাজার) গাছের চারা লাগানোর কথা থাকলেও সেখানে মাত্র ২০-৩০টি গাছ লাগানো হয়। বিষয়টি নিয়ে নিউজ করতে গিয়ে স্থানীয় সাংবাদিকরা উপজেলা প্রকৌশলীর কাছে বক্তব্য চাইলে তিনি কোনো বক্তব্য দেননি। বরং একদিনের মধ্যেই তিনি তড়িগড়ি করে পুনরায় ৭০০টি চারা গাছ এনে খালের পাড়ে লাগানোর উদ্যোগ নিয়েছেন বলে জানা গেছে। অথচ এর আগে গাছ লাগানোর জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ (৮ লাখ টাকা) প্রকৌশল অফিসের সংশ্লিষ্ট কর্মকতারা ভাগ-বাটোয়ার করে খেয়ে ফেলেছেন বলেও দুদুকে দায়েরকৃত অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।

 

খালপাড়ের স্থানীয় বাসিন্দা মো. ফখরুল ইসলাম অভিযোগ করে বলেন, খাল পুনঃখনন শেষে পাড় বাঁধার কথা থাকলেও অনেক স্থানে খালের পাড় আর আশেপাশের সকল ফসলী জমি প্রায় সমতল হয়ে গেছে। পাড় বাঁধার পর সেখানে ফলজ, বনজ ও ঔষধি গাছ মিলিয়ে অন্তত ২-৩ হাজার চারা গাছ লাগানোর কথা থাকলেও উপজেলা প্রকৌশল অফিস মাত্র ২০-৩০টি গাছ লাগিয়েই দায় সেরেছেন। বিষয়টি নিয়ে আমি গত ২২ সেপ্টম্বর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. জামাল হোসেনকে মাধ্যম করে উপ-পরিচালক, দুর্নীতি দমন কমিশন, কুমিল্লা বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছি। আশা করছি দুদক এ ব্যাপারে কার্যকর প্রদক্ষেপ গ্রহণ করবে।

 

ঘোলপাশা ইউনিয়নের হাজীগ্রামের বাসিন্দা মো. শাহজাহান বলেন, খাল খননের নামে হরিলুট সহ গাছ না লাগিয়ে ভুয়া বিলে সরকারি টাকা লুটপাট করা হয়েছে। ভবিষ্যতে এসব চোরকে আইনের আওতায় না আনলে দেশ চোরের খনিতে পরিণত হবে।

 

মুন্সীরহাট ইউনিয়নের পেঁচাইমুড়ি গ্রামের মো. ওমর ফারুক বলেন, উপজেলা এলজিইডি’র নির্বাহী প্রকৌশলী নুরুজ্জামান কানাইল খাল খননের নামে ব্যাপক অর্থ লুট করেছেন। তিনি মাটি ব্যবসায়ীদের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলে ট্রাক্টর প্রতি ২০০ টাকা হারে সমস্ত মাটি করে বিক্রি করেছেন। খালপাড়ে ২ হাজার গাছ লাগানোর কথা থাকলেও তিনি কোনো গাছ না লাগিয়েই বিল উত্তোলন করেছেন বলে শুনেছি। দুর্নীতিবাজ এ অফিসারের বিচার হওয়া দরকার।

 

উল্লেখ্য, উপজেলা প্রকৌশলী নুরুজ্জামান ২০২১ সালের ২৮ এপ্রিল চৌদ্দগ্রামে যোগদান করেন। যোগদানের পর থেকেই তিনি উপজেলা চেয়ারম্যানের তহবিলের টাকা তসরুপ সহ বিভিন্ন দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারি অর্থ লুটপাটের সাথে জড়িয়ে পড়েন। এছাড়াও তিনি সাবেক রেলপথ মন্ত্রী মুজিবুল হকের দাপট দেখিয়ে অনেক অনিয়মকে নিয়মে পরিণত করেন। তিনি উপজেলা পরিষদ তহবিল, এডিবি, রাজস্ব সহ বিভিন্ন খাতে অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িত হওয়ায় বিভিন্ন সময় নানান সমালোচনার মুখে পড়েন। টেন্ডারের মাধ্যমে নিজস্ব অনুসারী ঠিকাদারদের কাজ পাইয়ে দিতে সহযোগিতার বদৌলতে কমিশন বানিজ্য সহ বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে বানিয়েছেন অবৈধ সম্পদের পাহাড়। উপজেলা পরিষদের ভিতরের সরকারি কোয়ার্টারগুলো সংস্কারের নামে বিভিন্ন প্রকল্প পরিষদের মাসিক সভায় উপস্থাপন করে জোরপূর্বক সেগুলো পাশ করিয়ে নিতেন। পরবর্তীতে একান্ত অনুগত ঠিকাদারের লাইসেন্সে কাজগুলো সম্পন্ন হয়েছে মর্মে বিল উত্তোলন করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে শোনা গেছে। উপজেলা পরিষদের সম্মুখের গেইট নির্মাণেও অনিয়ম-দুর্নীতি করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছিল তার বিরুদ্ধে। বিধি মোতাবেক কাজ না হওয়া সহ প্রয়োজনীয় উপকরণ যথাযথভাবে দেওয়া হয়নি বলে খোদ প্রকৌশল অফিসেও কানাঘুষা হয়েছে বহুবার। কিন্তু তখন প্রভাবশালী এ কর্মকর্তার (প্রকৌশলী নুরুজ্জামান) ভয়ে প্রকাশে কোনো কর্মকর্তা বা অন্য ঠিকাদাররা মুখ খুলেননি। দায়িত্ব অবহেলা, অনিয়ম-দুর্নীতিতে যেমন তিনি পরিপক্ক তেমনি তেলবাজি আর চাটুকারিতায়ও তিনি ছিলেন সমান দক্ষ। অতিমাত্রায় তেলবাজি আর তোষামোদির ফলে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি তৎকালীণ স্থানীয় এমপি, সাবেক রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক ও উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুস সোবহান ভূঁইয়া হাসান এবং ঠিকাদারি সংশ্লিষ্ট কিছু প্রভাবশালী ইউপি চেয়ারম্যানের আস্থাভাজন হয়ে উঠেন। ২০২৪ এর ৫ আগস্ট এর গণঅভ্যূত্থান পরবর্তী সময়ে বোল পাল্টে জামায়াত-বিএনপি নেতাদের সাথেও বর্তমানে তিনি গড়ে তুলেছেন ব্যাপক সখ্যতা। এভাবেই চলছে তার কারিশম্যাটিক চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ। বিতর্কিত এসব কর্মকান্ডের ফলে তার উপর পরিষদের অনেক কর্মকর্তাই ভেতরে ভেতরে অসন্তুষ্ট বলে জানা গেছে। দীর্ঘদিন একই উপজেলায় কাজ করায় স্বৈরাচারী মনোভাব নিয়েই এখনো পরিচালনা করছেন নিজস্ব অফিস। তার মতের বাহিরে গেলেই নানামুখী হয়রানি করেন নিজ অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। তার ঔদ্ধত্বপূর্ণ আচরণে নাখোশ অফিসের সকলে। চৌদ্দগ্রামের সকল মধু খাওয়া শেষ তার। শোনা যাচ্ছে চুতর্দিক থেকে দুর্নীতি সহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ আসা শুরু করায় নিজ প্রচেষ্টায় তড়িগড়ি করে বদলি জনিত বিদায় নিতে তিনি এখন মরিয়া।

অভিযোগুলোর কথা অস্বীকার করে চৌদ্দগ্রাম উপজেলা নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নুরুজ্জামান বলেন, খালের পাড়ে গাছ লাগানো হয়েছে। জেলা প্রকৌশল অফিসের চূড়ান্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই বিল অনুমোদিত হয়েছে। আমার বিরুদ্ধে আনিত সকল অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। এর বেশি কিছু বলতে তিনি রাজী নন বলে জানান।

এলজিইডি কুমিল্লা জেলা নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আব্দুল মতিন বলেন, এ ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। বিষয়টি নিয়ে কেউ আমাকে অবহিত করেনি।

উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) সৈয়দ সাফকাত আলী বলেন, আমি এ বিষয়ে কিছুই জানি না। এ বিষয়ে জেনে তারপর কথা বলতে পারবো।

 

চৌদ্দগ্রাম উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. জামাল হোসেন বলেন, কানাইলের খাল খননটা আসলে আমাদের। পরিষদের প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতেই এর বিল অনুমোদিত হয়েছে।

জনপ্রিয়

ময়মনসিংহে যুবদলের ৪৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বর্ণাঢ্য র‍্যালি ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত

দুর্নীতির আতুড়ঘর চৌদ্দগ্রাম এলজিইডি অফিস

প্রকাশের সময় : ০৫:১২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৭ অক্টোবর ২০২৫

 

 

চৌদ্দগ্রামে খাল খননের নামে পুকুর চুরির অভিযোগ উপজেলা এলজিইডি প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে

ঘুস, কমিশন বানিজ্য, ভুয়া ভাউচারে বিল উত্তোলন সহ রয়েছে বিস্তর অভিযোগ

 

কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে উপজেলা নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নুরুজ্জামানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন টেন্ডারে স্বজনপ্রীতি, ঘুস ও কমিশন বানিজ্যের মাধ্যমে খালের মাটি বিক্রি, খালপাড়ে গাছ লাগানোর নামে ভুয়া ভাউচারে অন্তত ৮ লাখ টাকা আত্মসাত সহ ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি তার বিরুদ্ধে সরকারি প্রকল্পের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এর চেয়ারম্যান বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। অভিযোগে বলা হয়, খাল উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ধনুসাড়া মিজির ব্রিজ থেকে সিংরাইশ ব্রিজ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের কানাইল খাল পুনঃখননের জন্য ২ কোটি ৪৯ লাখ ৮১ হাজার ১০১ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। ২০২৪ সালের ২ আগস্ট টেন্ডারের মাধ্যমে কাজটি সম্পন্নের দায়িত্ব পায় দাউদকান্দির হাসানপুরের ‘মেসার্স লিবার্টি ট্রেডার্স’ নামীয় ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। কার্যাদেশ অনুযায়ী খালের পাড় বাঁধাইকরণ শেষে খাল থেকে উত্তোলনকৃত অতিরিক্ত মাটিগুলো উম্মুক্ত টেন্ডারের মাধ্যমে বিক্রির কথা থাকলেও অভিযোগ উঠেছে উপজেলা প্রকৌশলী নুরুজ্জামানের প্রত্যক্ষ যোগসাজসে স্থানীয় একটি মাটি চক্রের মাধ্যমে রাতের আঁধারে ট্রাক্টর প্রতি ২০০ টাকা হারে অতিরিক্ত সব মাটি বিক্রি করে দেওয়া হয়। কোনো কোনো স্থানে খালের পাড় না বেঁধেই সকল মাটি বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। এতে সরকারি সম্পদ লুট ও অর্থ লোপাট, পরিবেশের মারাত্মক দূষণ হয়। রাতের আঁধারে চক্রটি মাটি পরিবহনকালে এলাকাবাসীর রাতের ঘুম নষ্ট হওয়া ও ফসলী জমিন নষ্টের প্রতিবাদে বিভিন্ন সময় মাটি ব্যবসায়ীদের সাথে খাল পাড়ের জমির মালিক ও স্থানীয়দের বাগবিতন্ডার ঘটনাও ঘটেছে। পরে প্রশাসনের হস্তক্ষেপে এ সকল সমস্যা নিরসনের আশ^াস পেয়ে স্থানীয় বিক্ষুব্ধরা কিছুটা শান্ত হয়। শেষ পর্যন্ত ফলপ্রসু কোনো সমাধান না হওয়ায় স্থানীয়রা বিষয়টি নিয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে যায়। এ বিষয়ে সুরাহার জন্য ইউএনও সহকারী কমিশনার (ভ‚মি) কে দায়িত্ব দেন। পরে স্থানীয়দের দাবির প্রেক্ষিতে এবং অনিয়ম পরিলক্ষিত হওয়ায় চৌদ্দগ্রাম উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভ‚মি) পূর্বের কার্যাদেশটি বাতিল করেন। এরপর ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান খনন কাজ অসম্পূর্ণ রেখে চলে যায়। কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে তাদের সাথে বারবার যোগাযোগ করা হলেও তারা এ ব্যাপারে কোনো সাড়া দেয়নি বলে প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে। এদিকে ঠিকাদারের অনুপস্থিতিতে যে সকল স্থানে খালটি পূণঃখনন করা হয়েছে সেসকল স্থান থেকে উত্তোলনকৃত পরিত্যক্ত মাটিগুলো উপজেলা প্রকৌশল অফিসের যোগসাজসে স্থানীয় মাটি খেকোদের মাধ্যমে সরিয়ে মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে অবৈধভাবে বিক্রি করা হয়। এভাবেই খাল খননের নামে চলে পুকুর চুরি ও সরকারি অর্থের হরিলুট। চলতি বছরের ২৫ মার্চ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভ‚মি) কর্তৃক কার্যাদেশটি বাতিল করা হলেও কাজ সম্পন্ন দেখিয়ে ঠিকাদারকে চ‚ড়ান্ত বিল হিসেবে ২ কোটি ৩৯ লাখ ২৫ হাজার ১৫৬ টাকা পরিশোধের জন্য গত ১৯ জুন নির্বাহী প্রকৌশলী কুমিল্লা বরাবরে চিঠি প্রেরণ করেন উপজেলা প্রকৌশলী নুরুজ্জামান। এরপর সে আলোকে বিল উত্তোলন করা হয় বলেও জানা গেছে। উপজেলা প্রকৌশলীর এ দ্বৈত আচরণে জনমনে নানান প্রশ্নের সৃষ্টি দিয়েছে। এদিকে খালপাড় বাঁধার পর সেখানে বিভিন্ন জাতের বিপুল পরিমান (২-৩ হাজার) গাছের চারা লাগানোর কথা থাকলেও সেখানে মাত্র ২০-৩০টি গাছ লাগানো হয়। বিষয়টি নিয়ে নিউজ করতে গিয়ে স্থানীয় সাংবাদিকরা উপজেলা প্রকৌশলীর কাছে বক্তব্য চাইলে তিনি কোনো বক্তব্য দেননি। বরং একদিনের মধ্যেই তিনি তড়িগড়ি করে পুনরায় ৭০০টি চারা গাছ এনে খালের পাড়ে লাগানোর উদ্যোগ নিয়েছেন বলে জানা গেছে। অথচ এর আগে গাছ লাগানোর জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ (৮ লাখ টাকা) প্রকৌশল অফিসের সংশ্লিষ্ট কর্মকতারা ভাগ-বাটোয়ার করে খেয়ে ফেলেছেন বলেও দুদুকে দায়েরকৃত অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।

 

খালপাড়ের স্থানীয় বাসিন্দা মো. ফখরুল ইসলাম অভিযোগ করে বলেন, খাল পুনঃখনন শেষে পাড় বাঁধার কথা থাকলেও অনেক স্থানে খালের পাড় আর আশেপাশের সকল ফসলী জমি প্রায় সমতল হয়ে গেছে। পাড় বাঁধার পর সেখানে ফলজ, বনজ ও ঔষধি গাছ মিলিয়ে অন্তত ২-৩ হাজার চারা গাছ লাগানোর কথা থাকলেও উপজেলা প্রকৌশল অফিস মাত্র ২০-৩০টি গাছ লাগিয়েই দায় সেরেছেন। বিষয়টি নিয়ে আমি গত ২২ সেপ্টম্বর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. জামাল হোসেনকে মাধ্যম করে উপ-পরিচালক, দুর্নীতি দমন কমিশন, কুমিল্লা বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছি। আশা করছি দুদক এ ব্যাপারে কার্যকর প্রদক্ষেপ গ্রহণ করবে।

 

ঘোলপাশা ইউনিয়নের হাজীগ্রামের বাসিন্দা মো. শাহজাহান বলেন, খাল খননের নামে হরিলুট সহ গাছ না লাগিয়ে ভুয়া বিলে সরকারি টাকা লুটপাট করা হয়েছে। ভবিষ্যতে এসব চোরকে আইনের আওতায় না আনলে দেশ চোরের খনিতে পরিণত হবে।

 

মুন্সীরহাট ইউনিয়নের পেঁচাইমুড়ি গ্রামের মো. ওমর ফারুক বলেন, উপজেলা এলজিইডি’র নির্বাহী প্রকৌশলী নুরুজ্জামান কানাইল খাল খননের নামে ব্যাপক অর্থ লুট করেছেন। তিনি মাটি ব্যবসায়ীদের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলে ট্রাক্টর প্রতি ২০০ টাকা হারে সমস্ত মাটি করে বিক্রি করেছেন। খালপাড়ে ২ হাজার গাছ লাগানোর কথা থাকলেও তিনি কোনো গাছ না লাগিয়েই বিল উত্তোলন করেছেন বলে শুনেছি। দুর্নীতিবাজ এ অফিসারের বিচার হওয়া দরকার।

 

উল্লেখ্য, উপজেলা প্রকৌশলী নুরুজ্জামান ২০২১ সালের ২৮ এপ্রিল চৌদ্দগ্রামে যোগদান করেন। যোগদানের পর থেকেই তিনি উপজেলা চেয়ারম্যানের তহবিলের টাকা তসরুপ সহ বিভিন্ন দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারি অর্থ লুটপাটের সাথে জড়িয়ে পড়েন। এছাড়াও তিনি সাবেক রেলপথ মন্ত্রী মুজিবুল হকের দাপট দেখিয়ে অনেক অনিয়মকে নিয়মে পরিণত করেন। তিনি উপজেলা পরিষদ তহবিল, এডিবি, রাজস্ব সহ বিভিন্ন খাতে অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িত হওয়ায় বিভিন্ন সময় নানান সমালোচনার মুখে পড়েন। টেন্ডারের মাধ্যমে নিজস্ব অনুসারী ঠিকাদারদের কাজ পাইয়ে দিতে সহযোগিতার বদৌলতে কমিশন বানিজ্য সহ বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে বানিয়েছেন অবৈধ সম্পদের পাহাড়। উপজেলা পরিষদের ভিতরের সরকারি কোয়ার্টারগুলো সংস্কারের নামে বিভিন্ন প্রকল্প পরিষদের মাসিক সভায় উপস্থাপন করে জোরপূর্বক সেগুলো পাশ করিয়ে নিতেন। পরবর্তীতে একান্ত অনুগত ঠিকাদারের লাইসেন্সে কাজগুলো সম্পন্ন হয়েছে মর্মে বিল উত্তোলন করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে শোনা গেছে। উপজেলা পরিষদের সম্মুখের গেইট নির্মাণেও অনিয়ম-দুর্নীতি করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছিল তার বিরুদ্ধে। বিধি মোতাবেক কাজ না হওয়া সহ প্রয়োজনীয় উপকরণ যথাযথভাবে দেওয়া হয়নি বলে খোদ প্রকৌশল অফিসেও কানাঘুষা হয়েছে বহুবার। কিন্তু তখন প্রভাবশালী এ কর্মকর্তার (প্রকৌশলী নুরুজ্জামান) ভয়ে প্রকাশে কোনো কর্মকর্তা বা অন্য ঠিকাদাররা মুখ খুলেননি। দায়িত্ব অবহেলা, অনিয়ম-দুর্নীতিতে যেমন তিনি পরিপক্ক তেমনি তেলবাজি আর চাটুকারিতায়ও তিনি ছিলেন সমান দক্ষ। অতিমাত্রায় তেলবাজি আর তোষামোদির ফলে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি তৎকালীণ স্থানীয় এমপি, সাবেক রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক ও উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুস সোবহান ভূঁইয়া হাসান এবং ঠিকাদারি সংশ্লিষ্ট কিছু প্রভাবশালী ইউপি চেয়ারম্যানের আস্থাভাজন হয়ে উঠেন। ২০২৪ এর ৫ আগস্ট এর গণঅভ্যূত্থান পরবর্তী সময়ে বোল পাল্টে জামায়াত-বিএনপি নেতাদের সাথেও বর্তমানে তিনি গড়ে তুলেছেন ব্যাপক সখ্যতা। এভাবেই চলছে তার কারিশম্যাটিক চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ। বিতর্কিত এসব কর্মকান্ডের ফলে তার উপর পরিষদের অনেক কর্মকর্তাই ভেতরে ভেতরে অসন্তুষ্ট বলে জানা গেছে। দীর্ঘদিন একই উপজেলায় কাজ করায় স্বৈরাচারী মনোভাব নিয়েই এখনো পরিচালনা করছেন নিজস্ব অফিস। তার মতের বাহিরে গেলেই নানামুখী হয়রানি করেন নিজ অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। তার ঔদ্ধত্বপূর্ণ আচরণে নাখোশ অফিসের সকলে। চৌদ্দগ্রামের সকল মধু খাওয়া শেষ তার। শোনা যাচ্ছে চুতর্দিক থেকে দুর্নীতি সহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ আসা শুরু করায় নিজ প্রচেষ্টায় তড়িগড়ি করে বদলি জনিত বিদায় নিতে তিনি এখন মরিয়া।

অভিযোগুলোর কথা অস্বীকার করে চৌদ্দগ্রাম উপজেলা নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নুরুজ্জামান বলেন, খালের পাড়ে গাছ লাগানো হয়েছে। জেলা প্রকৌশল অফিসের চূড়ান্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই বিল অনুমোদিত হয়েছে। আমার বিরুদ্ধে আনিত সকল অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। এর বেশি কিছু বলতে তিনি রাজী নন বলে জানান।

এলজিইডি কুমিল্লা জেলা নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আব্দুল মতিন বলেন, এ ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। বিষয়টি নিয়ে কেউ আমাকে অবহিত করেনি।

উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) সৈয়দ সাফকাত আলী বলেন, আমি এ বিষয়ে কিছুই জানি না। এ বিষয়ে জেনে তারপর কথা বলতে পারবো।

 

চৌদ্দগ্রাম উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. জামাল হোসেন বলেন, কানাইলের খাল খননটা আসলে আমাদের। পরিষদের প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতেই এর বিল অনুমোদিত হয়েছে।